Home Article ইতিহাসের কালো অধ্যায়

ইতিহাসের কালো অধ্যায়

এক সময় ২৮ অক্টোবর নিয়ে লেখার আগ্রহ যেমন ছিল এখন কেন যেন সেই আগ্রহ নেই কারণ, এখন বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে বিগত ৭ বছরে আওয়ামী অসংখ্য ২৮ অক্টোবর ঘটনার ঘৃণ্য ইতিহাস রচনা করেছে। এদেশে নুনের চেয়ে খুনের মূল্য কম। প্রতি নিয়ত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কায়দায় এদেশের জনগণের ওপর পৈশাচিক নারকীয় ও বর্বর তাণ্ডব পরিচালনা করে চলছে। তবুও ২৮ অক্টোবর নিয়ে লিখতে হবে তাই লেখা। ২৮ অক্টোবর, ২০০৬। অন্য দিনের মতো একটি দিন, একটি মাস, একটি বছর নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক কালো অধ্যায়ের দিন। যা জাতীয় জীবনে একটি কলঙ্কের সংযোজন করেছে। এ দিনটি হয়তবা পল্টন হত্যা দিবস, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তাণ্ডব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকবে। ইতিহাসের পৈশাচিক আর হিরোশিমা নাগাসাকি, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি, এপ্রিল ফুল দিবসের মধ্য দিয়ে যেমনি আমাদের স্মৃতিতে এক বীভৎস চিত্র ভেসে ওঠে, ঠিক তেমনি শত বছর পরও ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করলে শিউরে উঠবে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হবে তার বিবেক, অমানবিকতার কথা মনে করে কেঁদে উঠবে মন। অভিশপ্তদের ঘৃণা করবে বিশ্বমানবতা পৃথিবী যতদিন থাকবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর।
পলাশীর আম্রকাননের নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজয়ের মতই আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে ২৮ অক্টোবরের কলঙ্কের বোঝা। বিগত দিনে জরুরি সরকারের লেবাসে ১/১১ সুড়ঙ্গ পথ ধরে এক যে মহাদানব আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে তার চূড়ান্ত রূপ এখন আওয়ামী সরকার করছে। দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ ১/১১ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ২৯ ডিসেম্বর ’০৯ অংশগ্রহণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্রের উত্তরণ। কিন্তু না! দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে ৮৭% ভোটের আজগুবি ফলাফল নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হলো মহাজোট সরকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই বিডিআর হত্যাকাণ্ড, টিপাইমুখ বাঁধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার, দক্ষিণ এশিয়া টাস্কফোর্স, ভারতের সাথে গোপন চুক্তি, এশিয়ান হাইওয়ে, সংবিধান সংশোধনী তথাকথিত যুদ্ধপরাধীদের বিচার, শিক্ষানীতিসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যেনতেন নীতি অবলম্বন করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাকশালী চেহারা নিয়ে পুর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
‘দিন বদলের আর ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার হাজারো প্রতিশ্রুতি ভুলে তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ জড়িয়ে পড়ে পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার, কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুর্নীতিতে। দলীয় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হত্যা লুটপাট আর বিরোধী দল দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দমন-নিপীড়ন, গুম, খুন আর গণহত্যা আর মানবাধিকার লংঘনে। ছাত্রলীগের হিংস্রতা, জঘন্যতা, পৈশাচিক, ভয়ঙ্কর দানবীয় চরিত্র, হত্যা, লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, সিট দখল, হল দখল ও নারী নির্যাতন, শিক্ষক লাঞ্ছনা, অস্ত্রবাজির নখরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রসমাজ। আকাশে বাতাসে লাশ আর বারুদের গন্ধ, রাতের অন্ধকারে অভিযানের নামে বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, নারী-শিশুর ওপর বর্বর নির্যাতন চলছে। হাসপাতালের বেডে আহতের আর্তচিতকার, গুম, খুন, গণগত্যা এখন শেখ হাসিনার রক্তপিপাসু হায়েনাদের কাছে অতিসাধারণ বিষয়ে পরিণত। রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে অনেককে। শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ডা: ফখরুদ্দিন মানিক, দেলোয়ার হোসেন তারই জ্বলন্ত প্রমাণন। হাত, পা, চোখ হারাদের সংখ্যা এখন শত সজ¯্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করণে লক্ষ-লক্ষ মেধাবী ছাত্রের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে।
সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে যোগ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। আলেম-উলামাদের ওউপর জুলুম-নির্যাতন, মসজিদ, মাদ্রাসা, দাড়ি টুপি, বোরকা-হিজাব ওয়ালাদের অপমান করা হয়ে পড়ে নিত্যদিনের কর্মসূচি। শুরু করে বোরকা বিরোধী অভিযান। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্দানশিন ও ইসলামী ছাত্রীসংস্থার মেধাবী মেয়েদেরকে ক্লাস এবং হলে থাকতে বাধা এবং বিভিন্ন জায়াগায় হিজাব পরা পর্দানশিন নারীদেরকে পুলিশ হয়রানি করে গ্রেফতার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এ অমানবিকতার হাত থেকে রেহাই পায়নি অন্তঃসত্ত্বা নারী, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মহিলা, বিদেশী পর্যটক ও ৮২ বছরের মা-বোনেরাও। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা হিটলার ও মুসোলিনির অক্ষশক্তির নৃশংসতা ও বর্বর কর্মকাণ্ডকেও যেন হার মানাতে বসেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার ভয়াবহতা তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে খ্যাতনামা সংবাদ সংস্থা আলজাজিরা, রয়টার্স, এএফপি ও ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়াান। তারা সিলেটের দু’জন ছাত্রদল নেতা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের দু’জন নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমিনুল ইসলাম এবং বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।’ কিন্তু এই সংখ্যা এখন শত শত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোট অনুযায়ীÑ পুলিশ এখন সবচেয়ে দুর্নীতি ও জননিরাপত্তা বিঘœকারী ও ক্ষমতাসীন দলের ঠ্যাংগাড়ে বাহিনীতে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে দীঘস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও জাতি। বরং যেসব মিডিয়া, পত্রপত্রিকা সমালোচনা করছে সেই সাংবাদিক হচ্ছেন হয়রানির শিকার, পত্রিকা, মিডিয়া করে বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার।’ ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠাধারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলেও তা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেয়ার উদ্যোগ সরকারের নব্য বাকশালী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। আমরা বিশ্বাস করি শহীদের রক্ত কথা বলে, এর আছে নিজস্ব এক শক্তি। ২৮ অক্টোবর ও ২৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি সেনাসদস্যদের রক্তের বেড়াজাল থেকে আওয়ামী লীগ কখনও রেহাই পাবে না।
২৮ অক্টোবরে সংঘটিত এই নিঃশৃংস ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি, বুকলেট, প্রতিবাদ, সিডি, ভিসিডি ও ওয়েবসাইট খোলাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। আমার এই লেখাটি তারই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
২৮ অক্টোবর সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবেÑ
উল্লেখ্য পল্টনে আওয়ামী লীগ চারদলীয় জোট সরকারকে উৎখাতের জন্য আন্দোলনের নামে জ¦ালাও পোড়াও বাসে আগুন সবই করেছে। ২৮ অক্টোবর ছিল চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন কিন্তু ২৭ অক্টোবর আওয়ামী সারা দেশে তাণ্ডব শুরু করে। বাড়িঘরে আগুন, হত্যা, লুট-পাটের জঘন্য আয়োজন শুরু করে তারা। সকাল ১০টা। কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে সেক্রেটারিয়েট সদস্য ভাইদের আসতে বলেছেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি। দু-একজন করে আসছেন। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার শোনা গেল। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ আমরা কয়েকজন সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখছি অনবরত আহত ও রক্তাক্ত ভাইয়েরা আসছেন। গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলের সামনে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে করণীয় ঠিক করা হলো। কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিষণœ ও যন্ত্রণার চাপ অনুভব করলাম, তাই বুঝতে আর বাকি নেই পরিস্থিতি ভালো নয়। এদিকে এই ৫ মিনিট যেন কয়েক ঘণ্টার মর্মবেদনা।
আহত ভাইদের সারি আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে। আর সহ্য করা যায় না। কেন্দ্রীয় সভাপতির হাতের ইশারায় অনুমতি পেয়ে দৌড়াচ্ছি পল্টন মসজিদের গলির দিকে। এদিক থেকে কয়েকজন ভাই ডাকছেন এখানে আসেন। তখনও বুঝতে পারিনি সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মনজু ভাইও এখানে আহত। কে যেন বলে উঠল, আহ! মনজু ভাইকে শেষ করে ফেলল। আল্লাহর দ্বীনের এই নির্যাতিত মানুষটির গায়ে আবারও ওরা আঘাত করেছে। তারা তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে তার ওপর লগি-বৈঠার চরম আঘাত চালিয়েছে। লগি-বৈঠার আঘাতে জর্জরিত করেছে সারাটি দেহ। শুধু তাই নয়, এর আগেও তিনি এ রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েকবার। সে আঘাতের যন্ত্রণায় তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। এ দৃশ্য দেখতে না দেখতে জড়িয়ে পড়লাম পরিস্থিতি মোকাবেলায়। একদিকে আমরা ৪০-৫০ জন ভাই, অপর দিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। যে ইটগুলো তারা আমাদের দিকে মারছিল সেইগুলো তুলে আমরা আবার তাদের দিকে ছুড়ে মারছি। এভাবে একদিকে সন্ত্রাসীদের মারণাস্ত্রের হামলা, অন্য দিকে আমরা নিরস্ত্র। এই নিরীহ মানুষগুলো ৭ ঘণ্টা মোকাবেলা করেছিল। ওরা এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। এ তো আল্লাহর দ্বীনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা। বাতিলের বিরুদ্ধে এক চরমপত্র। ১৪ দলের গালে একটি চপেটাঘাত। এখন জীবন দেয়ার প্রতিযোগিতা। ঈমানদারের জন্য শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার এক বিরাট সুযোগ। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। এক সময় আমি নিজেও মনে করতাম অস্ত্রের মোকাবেলায় অস্ত্র ছাড়া টিকে থাকা যায় না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভুল শুধরে নিয়েছি, বাকিটুকুর পরিশুদ্ধ হয়েছে ২৮ অক্টোবরের ঘটনায়। আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী ছিলাম সেদিন আমরা। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হচ্ছে নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না তারপরও আমরা টিকে আছি। কারণ বিজয় তো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।
হঠাৎ চিৎকার শুনলাম শাহাদাত উল্লাহ টুটুল ভাইকে মারছে। এ কথা শুনে উপস্থিত ভাইদের উদ্দেশে বললাম, আপনাদের মধ্যে যারা জীবন থাকা পর্যন্ত পিছিয়ে আসবেন না তারা হাত তুলুন এবং সামনে আসুন। ১৫-২০ জন ভাই এগিয়ে এলেন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে। যখন আমরা এগোতে লাগলাম তাদের ৪-৫ হাজার লোক পেছনে যেতে লাগল সেদিনের এ দৃশ্য না দেখে বিশ্বাস করা যাবে না। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তাঁর সাহায্য অনিবার্য। এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কোনো মু’মিন মুজাহিদের জিহাদের ময়দানে নারায়ে তাকবির বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির আল্লাহু আকবার শ্লোগান উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।” ২৮ অক্টোবর হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়েছি। যাক, সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি টুটুল ভাই না, গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। হায়েনারা তাকে হত্যার পর ফেলে রেখেছে গলির মধ্যে। কয়েকজন মিলে ধরে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের লাশের ওপর আক্রমণ তখনও থামছে না। লাশের ওপর তারা ছুড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। তখনো ঠিক বুঝতে পারিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুজাহিদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। পরে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা। এখন মিলিয়ে দেখলাম যে মনজু ভাইয়ের আহত হওয়া আর মুজাহিদের শাহাদাতের ঘটনা ছিল একই সময়। মুজাহিদ শাহাদাতের আগে ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমার প্রিয় দায়িত্বশীল সাবেক কেন্দ্র্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মনজু ভাই’। হজরত তালহা (রা) রাসূলে করিম (সা) কে রক্ষা করার জন্য একাই নিজের শরীরে অসংখ্য তীরকে বরণ করেছিলেন। আর সেই চেনতনায় উদ্ভাসিত হয়ে আমাদের প্রিয়ভাই শহীদ মুজাহিদও নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রিয় দায়িত্বশীলকে রক্ষা করতে গিয়ে। আর হয়তো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে চিৎকার করে বলেছিল আমি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছি কিন্তু এখানেই বিদায়। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে এত রকম শত শত ঘটনার জন্ম দিয়েছে আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদেরা।
এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা পর বুলেট এসে আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো লুটিয়ে পড়লাম হাঁটুর ওপর ভর করে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য জাহেদ হোসেন ভূঁঞা ভাই ও আব্দুল মান্নান ভাইসহ কয়েকজন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে এই জন্য। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলিবিদ্ধ পাটি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল এবং দলবেঁধে আমার সাথে আসতে লাগল। কিছুটা ধমকের সুরে বললাম, এতজন কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।
হাসপাতাল এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে দারুণ শৃঙ্খলা এ শহীদ কাফেলার ভাইদের মাঝে। এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত। নিজেদের কষ্ট হচ্ছে, রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তার বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’ এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ যেন আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। যোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলিবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্স’রে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে পায়ের হাড় দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলতে চায়নি। আমি বললাম, এই গুলিটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলিটি আমার পায়ের নামেই লেখা ছিল। আর এ বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না।
আজ হয়তো কেউ কেউ বলেন আমাদের প্রস্তুতির কথা। আর আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো থাকলে কি হতো? লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। সমাবেশ না করলে কি হতো সেটার বিষয় সেটাও হয়ত কাপুরুষতা হতো কি না? কিন্তু আমি মনে করি ২৮ অক্টোবর পুরো ঘটনার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ, পুলিশ প্রশাসন এবং বিএনপির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা। কারণ এমন ঘটনার পূর্বাভাস অনেক দিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু আমি দ্বিমত পোষণ করি, কারণ দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মারামারি করেছি, কী তাদের পরিচয়? দলে তারা আওয়ামী লীগ কিন্তু ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই গার্মেন্টসকর্মী ও পতিতালয়ের হিন্দা। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেত আর এ ধরনের সন্ত্রাসী একজন টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া, নামাজি, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। হিসাব হতো কাদের লাশ কয়টি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেখা হতো সেভাবে। অন্তত আল্লাহ তায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে কার উগ্র ও জঙ্গি। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের জন্য কল্যাণ নিহিত।
আল্লাহ বলেন, ‘আর বিপদ কখনো আমার অনুমতি ব্যতিরেকে আসে না।’ এটিই চিরন্তন সত্য। আমাদের কারো হিসাবে যেটি বিপদ, কারো জন্য তা আবার পরীক্ষা, কেউ নিচ্ছেন পরিশুদ্ধতা হিসেবে। আবার কেউ মনে করেন এটিই আমাদের পাওয়া। এসব মিলিয়ে ইসলামী আন্দোলন। ১৯৮৯ সালের ১৮ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিবিদ্ধ হয় রোজাদার শহীদ শফিকুল ইসলাম। হাসপাতালে সবাই চেষ্টা করছেন তাকে সুস্থ করার জন্য। কিন্তু সেদিন শফিকুল ইসলামের আকৃতি ছিল এরূপ, ‘ভাই’! আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি ঠিক, কিন্তু শহীদ হওয়ার আকাক্সক্ষা অনেক দিনের। সুতরাং আমাকে রোজাদার অবস্থায় শহীদ হওয়ার সযোগটুকু করে দিন।’ এ কথা বলতে বলতে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন। এই তো তার প্রস্তুতি!
কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা ১৪ দল কিভাবে পর্যালোচনা করছে। আমর মনে এর মধ্যে আওয়ামী বামরা রক্ত পিপাসু হিংসা উগ্রতা আর জঘন্য মানসিকতা বিশ্ববাসী দেখেছে এবং মিডিয়ার বদৌলতে দেখতে থাকবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো হাসপাতালে শত শত দর্শনার্থীর সাক্ষাৎ আর বিভিন্ন পর্যালোচনা শুনেছি। আর দর্শনার্থীর ধাক্কায় রোগীরা যেন কাবু কিন্তু করার কিছু নেই। এটি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই আমরা মানুষ। হাসপাতালে আহতদের অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে কেউ কেউ বলতে থাকেন আহ! সেদিনের প্রস্তুতি আরেকটু ভালো হওয়া দরকার ছিল। কেউ বলছে এতগুলো ফুটফুটে ছেলে আমাদের ভুলের কারণে বিদায় নিল। আবার কারো কারো প্রশ্ন আচ্ছা আপনারা জানতেন না এভাবে হামলা হবে? আবার কারো পর্যালোচনা আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আওয়ামী লীগ আবার ’৭২, ’৭৩-এর বাকশালী চরিত্রের বহিংঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আবার কেউ কেউ এ খবরও দিচ্ছেন। অনেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ছেড়ে ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একজন অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে হঠাৎ করে হাসপাতালে অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে আরেক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। এ হচ্ছে মানবীয় পর্যালোচনার হিসাব নিকাশ। আল্লাহর হিসাব তো ভিন্ন।
আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রন্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ রফিক, শহীদ ফয়সলের পরিবার। কিন্তু না। এটি আমার আপনার হিসাব হতে পারে, তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতি ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য। শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের ফরিয়াদ : আল্লাহর দরবারে আমার স্বপ্ন ছিল আমি শহীদের মা হবো, আল্লাহ যেন আমাকে একজন শহীদের মা হিসেবে কবুল করেন। শিপন সবসময় সত্যকে সত্য জানতো, মিথ্যাকে মিথ্যা জানতো। শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের গর্বিত মায়ের আহ্বান : আমার জীবনের আশা ছিল আমার ছেলে খালেদ বিন ওয়ালিদ হবে, নিষ্পাপ হবে। আমার ছেলে হাসান-হুসাইনের মতো হবে। আমার আরেক ছেলে শামসুল আলম মাহবুব। সবসময় দোয়া করতাম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা যেন গাজী কিংবা শহীদ হয়। সত্যি আমার প্রার্থনা আল্লাহপাক কবুল করেছেন। আমি মনেপ্রাণে সর্বদা আশা পোষণ করতাম মাসুম যেন ময়দানে সবার আগে থাকে। আল্লাহপাক আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমি আমার সাইফুল্লাহর রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রার্থনা সবসময় করি। শহীদ ফয়সলের গর্বিত মা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ঠিক এভাবে : তাদের কথা শুনেই মনে হয় তারা সত্যিই হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর উত্তরসূরি। হজরত ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর পথে কুরবান করে হজরত ইব্রাহিম (আ) যেভাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঠিক তেমনি তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ আমার এই সুশিক্ষিত বিনয়ী, ভদ্র, শান্ত, অমায়িক ও সুন্দর আচরণবিশিষ্ট সন্তানকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন সে জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।
শহীদ রফিকুল ইসলামের পিতার চাওয়া : আমার ছেলে আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছে বলে আমি মনে করি। কুড়িগ্রামবাসী সবাই তার জন্য কেঁদেছে। জীবনে সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়নি। সে সবসময় সৎ সঙ্গে মিশত এবং দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকত। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যাদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, লাশের ওপর নৃত্যউল্লাস করেছে, ভেঙে দিয়েছে দাঁত, উপড়ে ফেলেছে চোখ; তারা হয়তো বা ভাবতে পারে এর মধ্য দিয়ে তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ এই পৃথিবীতেই শেষ নয়। বরং তাদের এই একটি আঘাত আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের কাছে জান্নাতের নিকটবর্তী। যারা আঘাতের পর আঘাত চালিয়েছে এ নিষ্পাপ মানুষের দেহে, তারা কি আজ উত্তর দিতে পারবেন হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের জিজ্ঞাসারÑ ‘কী অপরাধ আমার সন্তানের? তাকে হত্যা করা হয়েছে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই আমি শহীদের মা এজন্য আমি গর্বিত। কিন্তু কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সন্তানের দাঁতগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে? এই মুখ দিয়ে তো সে মহাগ্রন্থ আল কুরআন মুখস্থ করেছে। যাদের বুকের ওপর নৃত্য-উল্লাস করা হয়েছে, তারা কি জানে যে কপালে লাথি মারা হয়েছে সে কপালে দিনে পাঁচবার করে আল্লাহকে সেজদা করতো! পড়তো তাহাজ্জুদ নামাজ। যে হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে সে হাত দিয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতো, যে পা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সে পা দিয়ে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতে যেত। এ হাজারো জিজ্ঞাসার জবাব আজ তাদের কাছে আছে কি? যারা সেদিন আমাদেরকে পিছিয়ে দিতে এসেছে তারা আমাদেরকে অনেক পথ এগিয়ে দিয়েছে। আরেকবার আমরা দেখে নিয়েছি আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। যাদের সাহস আমাদের এগিয়ে দেয়। যাদের আল্লাহর নির্ভরতা এ কাফেলার কর্মীদের আশান্বিত করে। যাদের ত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা দেখেছি তাদেরকে। আমরা দেখেছি তাকে যাকে ঘিরে এ জনসভার আয়োজন। শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। যা ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর অবিকল প্রতচ্ছবি। এমনি এক জনসভায় অবিরাম গুলিবর্ষণ চলাকালে মাওলানা মওদূদীকে বসে পড়ার জন্য অন্যরা অনুরোধ করলে দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছিলেন, আমিই যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তাই আমাদের বিশ্বাস শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না, একদিন কথা বলবেই।
শাহাদতের জন্য শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মন কেমন পাগলপারা ছিল এই ঘটনা থেকে তা উপলদ্ধি করা যায়। খুব সম্ভব ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজন করে আলোচনা সভার। সকল অতিথিরবৃন্দ উপস্থিত আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানে আমাদের প্রিয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই প্রোগ্রামে এসে হাজির। আমি দাঁড়িয়ে রিসিভ করে বললাম সরি মোল্লা ভাই আপনি এসেছেন এজন্য মোবারকবাদ। কারণ মোল্লা ভাই আমাদের দাওয়াতি মেহমানের মধ্যে ছিলেন না। তবু তিনি নিজ উদ্যোগে আলোচনা সভায় হাজির হয়েছেন। বলতে না বলতে তিনি বললেন, শুন ২৮ অক্টোবর ২০০৬ আমি ঐ প্রোগ্রামে অনুপস্থিতির বেদনা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। পল্টনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। যেখানে আমাদের ভাইয়েরা শহীদ আর গাজী হয়েছে। ঐ দিন আমি ঢাকায় ছিলাম কিন্তু আমীরে জামায়াত আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব খোজ খবর রাখতে বললেন। এই জন্য আমি পল্টনে ছিলাম না। সেদিনের এই অনুপস্থিতির বেদনা থেকে তোমাদের দাওয়াত না পেয়েও বেদাওয়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে গেলাম, এই কথাগুলো মোল্লা ভাই স্টেজে বসে বসে বললেন। তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু আজ সারা পৃথিবী জানে তিনি কত গভীরভাবে শাহাদাতের চেতনাকে লালন করতেন। আজ তিনি সে ধনদের কাতারে একজন।
কিন্তু এ কথা সত্য যে, ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুম নির্যাতন যত বেশি আসবে আন্দোলন তত মজবুত ও শক্তিশালী হবে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দমন করার জন্য হামলা, মামলা ও খুন, গুম, অপহরণ, হত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাট কর্মসূচি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদদে এদেশে ইসলাম ও তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র। প্রতিটি মুহূর্তে শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, পিতা হারা সন্তানের করুন চাহনী, মা হারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণী পেশার মানুষ। বৃদ্ধবনিতা এমনকি অনেক নিষ্পাপ শিশুও রেহাই পায়নি জালেমের বুলে্েটর আঘাত থেকে। আর এর মধ্যে দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির অতীতের থেকে জনপ্রিয় ও জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর এই প্রথম জামায়াত স্থানীয় ও উপজেলা নির্বাচনে এত আশানুরূপ ফলাফল লাভ করেছে। ইসলামী আন্দোলনের ওপর হাজারো জুলুম নির্যাতনের মাঝে এই কাফেলা কর্মীদের ত্যাগ, কোরবানি, ভ্রাতৃত্ব, পরকাল ভীতি এবং নিজেদের পরিশুদ্ধ করার অনেক উপাদানের সন্ধান পেয়েছে এই সময়। কারণ যারা আমাদের পিছিয়ে দিতে চায় তাদের অনেক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য কল্যাণ রেখেছেন। আমাদের প্রতিপক্ষের অপপ্রচার অপবাদ হিংসা উসকানির কারণে মানুষের মনে আন্দোলনকে জানার এক প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ এ আন্দোলনে শরিক হচ্ছে। অনিবার্য হয়ে উঠছে তার বিজয়।
শহীদেরা তাদের মাবুদের সাথে তামাম জিনিসের বিনিময় করে শুধু একটি বাক্যের ভিত্তিতে ‘‘রাদিয়া আল্লাহু আনহুম অরাদু আন্হ’’। যারা এই মহৎ কাজে নিজেদের জান-মাল, পিতা, পুত্র, ভাই বেরাদর, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের মায়া এবং ঘরের আরাম-আয়েশ, সবকিছুই বিসর্জন দিতে পারে, তাদের চেয়ে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের অধিকারী আর কে? সাফল্য ও বিজয়ের সিংহদ্বার তাদের জন্য ছাড়া আর কার জন্য উন্মুক্ত হতে পারে? তাদের শক্তির উৎস অনেক গভীর থেকে প্রোথিত। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ১৮৮২ সালে শহীদ দিবস উপলক্ষে লিখেছেন : মানুষকে যদি মানুষের মত বাচিতে হয় তাহা হইলে এই মানুষ খেকো আদর্শকে দুনিয়ার প্রতিটি প্রান্ত হইতে চিরতরে উৎখাত করিতে হইবে, নির্মূল করিতে হইবে। এই রক্তপিপাসু অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুনিয়ার প্রতিটি প্রান্তে গড়িয়া তুলিতে হইবে প্রতিরোধ। বাংলার প্রতিটি জনতাকে এই বন্য আদর্শের আসল চেহারা আর অনুসারীদের আসল চরিত্র বুঝাইতে হইবে। দেশকে বাঁচাইতে হইলে সর্বোপরি ঈমান আকিদা লইয়া বাঁচিতে চাহিলে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের সাথে সিদ্ধান্ত লইতে হইবে। ঈমান-দার প্রতিটি মানুষকে আজ অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। অন্যথায় শুধু বুক চাপড়াইয়া শহীদদের জন্য শোক করিয়া কোন লাভ নাই। আজ গজলের একটি কলিগুলি বড় আবেগে-আপ্লুত কণ্ঠে গাহিতে ইচ্ছা করিতেছে- “তোরি দেশের বাঁকে বাঁকে
লক্ষ্য শহীদ আজো ডাকে
তবুও কি তুই রইবি বেহুঁশ
আজি একথার জবাব যে চাই” জবাব দিতে হইলে মুখের কথায় অথবা মিটিং মিছিল আর প্রতিবাদ সভায় কাজ হইবে না। ঈমানের আলোতে প্রজ্বলিত বক্ষের তাজা শহীদি খুনের নজরানা চাই।”
আজ জীবিত আবদুল কাদের মোল্লার চাইতে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা অনেক বেশি শক্তিশালী। জেল-জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন চালিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না, বরং দ্বীনের বিজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।”
হজরত রাশেদ বিন সা’দ জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন: কোনো এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (সা) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’ হজরত উম্মে হারেসা বিনতে সারাকা থেকে বর্ণিত, “তিনি হুজুর (সা) এর দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি হারেসা সম্পর্কে কিছু বলবেন না? জঙ্গে বদরের পূর্বে একটি অজ্ঞাত তীর এসে তাঁর শরীরে বিঁধে যায় এবং তিনি শহীদ হন। যদি তিনি জান্নাতবাসী হয়ে থাকেন তাহলে আমি সবর করবো, অন্যথায় প্রাণ ভরে কাঁদব। হুজুর (সা.) জবাব দিলেন, হারেসার মা, বেহেশতে তো অনেক বেহেশতবাসীই রয়েছেন তোমার ছেলে তো সেরা ফেরদাউসে রয়েছেন।” যারা জালিমশাহির এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। আল্লাহ তাদের শহীদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।
প্রিয় ভাইদের হারিয়ে আজ আমরা শোকাহত। বৃদ্ধ বাবা-মা আর পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে হারানোর বেদনায় জ্বলতে থাকবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত। মহান রবের দরবারে সন্তান হারা মায়ের আহাজারি আর প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চোখের পানি কি কোনই কাজে আসবে না? অবশ্যই আসবে। একদিন তারা শহীদের পিতা মাতা হিসেবে আল্লাহর সম্মানিত অতিথি হবেন। সেদিন জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়তে থাকবেন শহীদেরা। এটাই তো শহীদের চূড়ান্ত সফলতা! ন্যায় ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী আদর্শিক দ্বন্দ্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস।
আমাদের বিশ্বাস এই দুনিয়ার আদালতে এই সকল হত্যার ন্যায্য বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে খুনিরা রেহাই পাবে না। সর্বোপরি মহান মাবুদের কাছে ফরিয়াদ, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও।’ আমিন।

লেখক : ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও
সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

SHARE