Home Diaries of the Martyr Families শপথকে শানিত করার দিন

শপথকে শানিত করার দিন

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এমন একটি সংগঠন যারা দেশের ছাত্রসমাজকে কল্যাণের পথে আহ্বান জানায়, ছাত্রসমাজকে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে। লেখাপড়ার পাশাপাশি কুরআন-হাদিসের চর্চা করে এবং আমল করে। এমন একটা সুন্দর দলের তুলনা অন্য কোন দলের সাথে মিলে না। এরা মানুষকে নামাজি ও ভদ্র বানায়। এই বাংলাদেশের বুকে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অপকর্মের প্রমাণ দেখাতে পারবে না। আল্লাহর রহমতে এই সংগঠন একজন ছাত্রকে পিতামাতার চক্ষুশীতলকারী সন্তান হিসেবে সমাজে উপহার দেয়।

এই সংগঠনই করতো শহীদ সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম, শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপন, শহীদ মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম ও শহীদ রফিক, শহীদ ফয়সল। তারা তাদের এলাকার শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সুপরিচিত ছিল। তাদের কথা মনে হলে এখনো তাদের এলাকার লোকেরা চোখের পানি ফেলেন। সেদিন যারা পল্টনে শহীদ হায়েছেন তাদের চরিত্র হুবহু একই রকম ছিল। মাসুম শিশুকাল থেকে (৬-৭ বছর বয়স) নামাজ পড়তো জামাতের সাথে। ছোটবেলায় খেলা করছেÑ বললাম, আজান হয়েছে মসজিদে যাও। সাথে সাথে খেলা ছেড়ে মসজিদে চলে যেত। কোন প্রকার অবহেলা করতো না। রোজার বেলায়ও তাই করতো ৫-৬ বছর বয়স থেকে রোজার প্রতি আকর্ষণ তীব্র। পাল্লা দিয়ে রোজা রাখতো চাচাতো ভাইবোনদের সাথে। সাইফুল্লাহ কোন দিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না। সে খুবই ধৈর্যশীল ছিল।

অভাবীদের অভাব দূর করার ব্যাপারে সে ছিল তৎপর। এক গরিব ছাত্রের ভর্তির টাকার ব্যবস্থা করে নিজের প্রিয় পছন্দের জামাটি পরিয়ে দিয়ে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শহীদ মাসুম।

ছাত্রদেরকে পয়সা ছাড়া পড়াতো। প্রতি বছর নতুন বই কিনে দিতাম। বছর শেষে সেই বইগুলো বিনা পয়সায় গরিব ছাত্রদেরকে দিয়ে দিত। শুধু বইয়ের বেলায় নয়, সব ব্যাপারেই যেমন শখের খেলনাÑ আমেরিকা থেকে তার মামা তার জন্য এনেছিল, সেই খেলনা ইসলামের পথে ছেলেদেরকে আনার জন্য এবং ভাব জমানোর জন্য দেখা গেল সে দিয়ে দিয়েছে। পয়সা খরচ করে ছোট ছাত্র ভাইদেরকে খাওয়াতো। বাড়িতে ডাবগাছ, আমগাছ ও বরইগাছ আছে। সেখান থেকে ফল পেড়ে তাদেরকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতো। এলাকার প্রত্যেকটি ছেলের জন্য অন্য রকম একটা টান ছিল তার।

সংগঠনে সময় দিত বেশি। মাঝে মাঝে আমি বকা দিতাম পড়াশোনা জন্য। কিন্তু নিয়মিত পড়াশোনা করতো। তার একটা সুন্দর রুটিন ছিল। লেখাপড়ায় ও মেধাবী ছিল। মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ৩টি লেটারসহ ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইএসসি পাস করে ইংলিশে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু খুব তার পেরেশানি ছিল ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করার। কারণ সেখানে তার প্রিয় খালা তো তার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কিন্তু সেই আশা আওয়ামী হায়েনারা পূরণ হতে দিল না।

শহীদ মাসুমের ভেতরে কখনো অলসতা স্থান পেতে পারেনি। সংগঠনের কাজের বেলায় ছিল সে সদাতৎপর। রাত জেগে পোস্টারিং ও দেয়াল লিখনের কাজ সে করেছে নির্ভয়ে। সাথীদের নিয়ে নিজের হাতে চুলায় গাম তৈরি করে সারা রাত না ঘুমিয়ে এসব কাজ করতো। শত কাজের মাঝেও যখনই দায়িত্বশীল ডাকতেন সব কাজ ফেলে দিয়ে তাতে সাড়া দিত। মোট কথা সংগঠনের জন্য সে ছিল নিবেদিতপ্রাণ। পাড়ার দুষ্টু ও চঞ্চল ছেলেদেরকে খেলাধুলার মাধ্যমে সংগঠনে ভেড়ানোর চেষ্টা করতো। এর জন্য নিয়মিত খেলাধুলায় তাদের সাথে সময় দিত। কিছু ছেলে ফজরের নামাজ পড়ার বেলায় অবহেলা করতো বলে ফুটবল খেলার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে ফজর নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করতো শহীদ মাসুম।

সুন্দর কবিতা লিখতে পারতো। সিগারেট নিয়ে, জন্মভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে সাড়া জাগানোর মতো কবিতা লিখেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই কবিতাগুলো বন্যার সময় হারিয়ে গিয়েছে বিধায় উল্লেখ করতে পারলাম না। শহীদ মাসুম অনেক সুন্দর গান করতে পারতো। এলাকার বিভিন্ন গ্রোগ্রামে স্টেজে সুন্দর সুন্দর গান গেয়ে শুনাতো সবাইকে। শহীদ মাসুম সুন্দর সুরে কুরআন তেলাওয়াত করতো। এক কর্মী বোন সকালবেলা আমর সাথে দেখা করার জন্য আমাদের বাসায় এসেছিলেন। মাসুম সামনের রুমে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছিল। সেই সময় বাইরে থেকে তার কুরআন তেলাওয়াতের সুর শুনে কর্মী বোনটি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ও শহীদ হওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এক পর্যায়ে এ কথাটি উল্লেখ করেছিলেন বোনটি। ও বেঁচে থাকতে এত কিছু খেয়াল করতাম না। চলে যাওয়ার পর এখন ওর সব গুণ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এখন ওর প্রতিটি আচরণ স্মৃতি হয়ে মনে নাড়া দেয়। আর ওর হারানো ব্যথা সহ্য করতে কষ্ট হয়। ও ছিল সমাজসেবী বালক। কারো কোন অসুখের খবর কানে এলে সোজা হাসপাতালে গিয়ে হাজির হতো। রক্ত দেয়া থেকে শুরু করে রাত জেগে সেবা করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনে সে ছিল তাৎপর।

এমন চক্ষুশীতলকারী সন্তান ছিল মাসুম। সে শুধু মায়েরই চক্ষশীতলকারী সন্তান ছিল না। সারা এলাকার মুরব্বিদের নজরকাড়া একজন সন্তান ছিল। তাকে আওয়ামী-সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলল এ কথাটি এখনো এলাকাবাসী সহ্য করতে পারছে না। যার বিরুদ্ধে জীবনে একটি নালিশ ছিল না কারো, সেই ২ নভেম্বরে তার শাহাদাতের খবরে দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকার বাইরের জেলা থেকে মাদারটেক বাগানবাড়িতে ১৩০/১৬ তে সবাই এসে ভিড় করেছিল শেষবারে মতো একনজর দেখার জন্য। লক্ষণীয় হলো, সে ঢাকার বাইরে যেখানে বেড়াতে গিয়েছিল সেখানকার লোকদের সাথে এমন সুন্দর আচরণ করতো যে তারা তাকে ভুলতে পারতো না। শহীদ মাসুম খেলায় সুন্দর সুন্দর প্রাইজ নিয়ে ঘরে ফিরতো মেডেল, কাপ, কাচের প্লেট। এখনো সব কাচের প্লেট স্মৃতি হিসেবে যতœ করে রেখে দিয়েছি। শিবির দায়িত্বশীলরা এলে সেগুলো তখন ব্যবহার করে মনে তৃপ্তি পাই। ও আল্লাহর কাছে চলে যাওয়ার পর এখন বুঝি কী সম্পদ হারিয়েছি। ওকে আমি একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। এই পৃথিবীতে সব সুখ আছে। এই সুখের ভেতরেও প্রতিটি মুহূর্তে হৃদয়ের ক্ষতস্থানে ব্যথা অনুভূত হয়। সেই মাসুমকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতাম না। মাসুম ছাড়া আমার কোন কিছু ভাল লাগতো না। সেই মাসুমকে ছাড়া আমি চোখের পানিকে সাথী কওে বেঁচে আছি। সব আছে মাসুম নেই। দেখতে দেখতে চারটি বছর পূূর্ণ হলো। রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবরে চারটি বছর পাও হয়ে গেল। কিন্তু মাসুম শিপন, মুজাহিদ ও ফয়সলদের হত্যার কোন বিচার হলো না।

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই আমরা শহীদের মা হতে পেরেছি। কারণ একজন শহীদ কাল হাশরে ৭০ জনকে শাফায়াত করতে পারবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ছিল। এই ঘটনার কারণে আমাদের ছেলেরা কত বড় মর্যাদা লাভ করেছেন এর শুকরিয়া আদায়ের শেষ নেই।

ইসলামের দুশমনরা মাসুম, শিপন, মুজাহিদের হত্যা করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কাজকে বন্ধ করে রাখতে পারেনি। ওরা নেই, দুনিয়ায় ওদের হারানো শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে শত শত মাসুম, শিপন, মুজাহিদ এগিয়ে আসছে ওদের শূন্যস্থান দখল করার জন্য। এই ইসলামী কাফেলার স্রোতকে দুনিয়ার কোনো শক্তি রোধ করতে পারবে না। আল্লাহর পথে বাধা দিতে গিয়ে তারাই ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে ফেরাউন ও নমরূদের মত।

এই আটাশে অক্টোবরে নতুন করে শহীদদের আত্মদানের কথা স্মরণ করে আমাদের দ্বীন কায়েমের পথ চলা হোক আরো বেগবান। আর চোখের পানি নয়, আওয়ামী হায়েনাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে দেশের ঈমানদার জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব আজ আমাদের অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ওপর। আল্লাহপাক দায়িত্ব পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখিকা : শপথকে শানিত করার দিন

শহীদ মাসুমের মা

SHARE